অরুণা রায় একজন সমাজকর্মী এবং মজদুর কিষাণ শক্তি সংগঠন (MKSS) এর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর কাজ এবং নেতৃত্বের অন্যতম ফসল তথ্যের অধিকার (আর.টি.আই.) আইনের ২০০৫ প্রণয়ণ। এটি একটি যুগান্তকারী আইন, যা নাগরিকদের সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্বচ্ছতা ও উপযুক্ত জবাব পাওয়ার অধিকার সম্পর্কে ক্ষমতাশীল করে।
গত চার দশকে তিনি আরও বেশ কয়েকটি জন-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। যেমন, রাইট টু ওয়ার্ক বা শ্রমের অধিকারের প্রচারাভিযান, যা হয়ে ওঠে MGNREGA প্রতিষ্ঠার অন্যতম চালিকাশক্তি এবং এছাড়াও তিনি পুরোভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন খাদ্যের অধিকার আন্দোলনে। ২০০০ সালে কমিউনিটি লিডারশিপের জন্য তিনি ম্যাগসেসে পুরস্কারে সম্মানিত হন।
আই.ডি.আর.-এর সাথে এই সাক্ষাৎকারে,শ্রীমতী রায় আলোচনা করলেন অংশগ্রহণমূলক আন্দোলন গড়ে তোলা ও টিকিয়ে রাখা, পরিবর্তনের স্বার্থে সংঘর্ষ (সংগ্রাম)-এর ভূমিকা, এবং মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরের শক্তি সম্পর্কে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার ভারতের মতো একটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং; কেনই বা নাগরিক সমাজকে তা টিকিয়ে রাখার জন্য লড়তে হবে। তিনি এমন এক মুক্তমনা সমাজের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে তরুণ প্রজন্ম সাংবিধানিক নৈতিকতার বলে নির্ভয়ে গঠনমূলক কাজ করতে পারে ।
আপনার জীবনের গোড়ার দিকের কথা এবং চিন্তাভাবনা সম্পর্কে কিছু বলুন?
আমার জন্ম ভারতের স্বাধীনতার এক বছর আগে। এর ফলে আমি ভারত নামে এক নবজাতক দেশের জীবনযাত্রার সঙ্গী হলাম। আমি দিল্লিতে বড় হয়েছি। সুতরাং আমি, যাকে বলে, দিল্লিওয়ালি । আমার পরিবার প্রগতিশীল, তাতে সকলেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। যেমন, আমার মা গণিত এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, আমার বাবা মাত্র ১০ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করতে গিয়েছিলেন, এবং আমার ঠাকুমা সিনিয়র কেমব্রিজ-পাস ছিলেন। সাম্যমূলক বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা দৈনন্দিন রুটিনের অংশ ছিল। যারা বাড়িতে আসতেন, শ্রেণী, জাত বা সাক্ষরতার স্তর নির্বিশেষে, তারা সবাই একসঙ্গে বসে একই রকম কাপ থেকে চা খেতেন। তখনও বুঝিনি যে, অনেকের জন্যেই এটা ‘স্বাভাবিক’ নয়। সমস্তরকম উৎসব পালন করে এবং সব সম্প্রদায়ের মনিষীদের গল্প শুনে আমি বড় হয়েছি।
ছোটবেলায় আমাকে প্রথমে চেন্নাইয়ের কলাক্ষেত্রে পাঠানো হয় শাস্ত্রীয় নৃত্য ও সঙ্গীত শেখার জন্য। পরে অন্যান্য নানান স্কুলে অধ্যয়ন করেছি। ১৯৬৭ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দ্রপ্রস্থ কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠ শেষ করেছি। তারপর সেই কলেজেই এক বছর শিক্ষকতা করেছি। ১৯৬৮-তে সিভিল সার্ভিসের ইউনিয়ন টেরিটরি ক্যাডারে যোগদান করি। সরকার আমাকে প্রথমে পন্ডিচেরিতে, এবং তারপর দিল্লিতে পোস্ট করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে রাজস্থানের দরিদ্র গ্রামবাসীদের সঙ্গে গঠনমূলক কাজ করার জন্য পদত্যাগ করেছিলাম।
আমি সারা জীবন কর্মব্যস্ততার মধ্যে থাকার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। আমার মা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও দক্ষ মানুষ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারীরা পুরুষদের চেয়ে কোনও অংশেই কম নন। তাই, বহির্জীবনে অংশগ্রহণ না করতে পারার হতাশা তাঁর মধ্যে দেখেছি। পুরুষ-শাসিত এই জগতে যে নারীদের সবসময় ঘরোয়া সামগ্রী হিসেবে অবজ্ঞা করা হতো, তা আমার মায়ের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। এর ফলে আমার মনে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে, মহিলাদের ঘরোয়া পরিধির বাইরেও একটি জীবন থাকা চাই।
আমার জীবনবোধের ভিত্তিতে এমন চিন্তা ছিল যে, সব মেয়েদেরই নিজেকে প্রকাশ করার জন্য একটা জায়গা থাকা দরকার। একরকম বলা যায় যে, আমার প্রাথমিক স্তরের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ছিল নারীবাদী, ও তার ঠিক পরেই, জাতপাতবিরোধী। আমার বাবা, ঠাকুরদা-ঠাকুমা এবং প্রপিতামহ নানান বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, বিশেষ করে জাতপাতের। তা ছাড়াও, অস্পৃশ্যতা এবং বর্ণবৈষম্যের অনৈতিকতা-বিষয়ক আলোচনা আমার ছোটবেলার নিত্য জীবনের অংশ ছিল। দেশভাগের পরপরই দিল্লিতে বড় হয়ে ওঠার কারণে ধর্মীয় বৈষম্য, হিংসা এবং তা থেকে সৃষ্টি হওয়া বিপর্যয়ের বোধ আমার আবেগীয় স্মৃতির র অংশবিশেষ।
সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার আগে ভেবেছিলাম যে, এটি এমন এক জায়গা যেখানে সক্রিয়ভাবে সমাজের বৈষম্য ও অসাম্য হ্রাসের কাজ করা যায়। সিভিল সার্ভিস ছাড়ার পরে আমি রাজস্থানের তিলোনিয়াতে সোশ্যাল ওয়ার্ক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার বা বেয়ারফুট কলেজ নামে একটি অলাভজনক সংস্থার সাথে কাজ শুরু করি।
ওই নয় বছরে আমি নিজেকে ডি-স্কুলিং করেছি। ভুক্তভোগী মানুষের চোখ দিয়ে আমি শিখেছি দারিদ্র্য, জাতপাত ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিষয়ে। তারই সঙ্গে আমি শিখি সাংস্কৃতিকভাবে পৃথক হলেও, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কীভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। আমি বুঝতে পারছিলাম, মানুষ কেন দারিদ্র্যের হাত থেকে সহজে মুক্তি পায় না। এসব কিছুই আমি শিখছিলাম, অত্যন্ত মেধাবী, খেটে-খাওয়া মানুষের কাছে।
তাঁদের সকলের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন নওরতি, যিনি চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমার বিশেষ বন্ধু। নওরতি দলিত সম্প্রদায়ের মেয়ে। আমার থেকে বয়সে একটু ছোট। আমাদের প্রথমবার দেখা হওয়ার সময় তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। এর পরে নওরতি সাক্ষর হন ও শ্রমিকনেতা হিসেবে অন্যায্য ন্যূনতম মজুরির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্বদান করেন। তিনি একাধারে নারী-অধিকারের স্বীকৃত নেতা, কম্পিউটার অপারেটর, এবং সরপঞ্চ। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে তার আন্দোলনের প্রচারে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। একদিকে আমি সচেতনতাবৃদ্ধি-কর্মসূচীর মাধ্যমে আইনি পরামর্শ দিচ্ছিলাম, অন্যদিকে, তিনি জনগণকে সংগঠিত করছিলেন। অবশেষে, ১৯৮৩ সালে, সুপ্রিম কোর্ট, সঞ্জিত রায় বনাম রাজস্থান সরকার মামলায়, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ এবং অনুচ্ছেদ ২৩ তলবের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরি-বিষয়ে একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন। নওরতি আমার কমরেড। আমরা একসঙ্গে সতীদাহ এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। আর.টি.আই., MGNREGA এবং অন্যান্য অধিকার-ভিত্তিক কর্মসূচির জন্যেও লড়েছি। তিনি একজন অত্যন্ত সাহসী মহিলা, এবং আমাদের এখনও খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
তিলোনিয়াতে থাকাকালীনই, অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সাংগঠনিক পরিকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারলাম। সকলের সঙ্গে সাম্য বজায় রেখে কাজ করার গণতান্ত্রিক উপায় বার করা কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে, কীভাবে নানা মানুষের অংশগ্রহণ সহজতর করা যাবে এবং কী কী বিষয় নিয়ে একেবারেই আপোষ করা চলবে না, তা ভাবা প্রয়োজন। প্রথমে মন দিয়ে শুনতে হবে এবং ভিন্ন মতকে মেনে নিতে হবে। এও মানতে হবে যে একমত হতে গেলে সকলকেই কিছু না কিছু ত্যাগস্বীকার করতে হবে। এর জন্যে দরকার একটি মৌলিক কাঠামো।
ধীরে ধীরে বুঝলাম যে, আমি ডেভেলপমেন্ট-ওয়ালি হতে চাই না । বরং, সাংবিধানিক অধিকারের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে চাই। খেটে-খাওয়া মানুষদের সঙ্গে কাজ করার জন্য মধ্য রাজস্থানে গেলাম। আমার দুই বন্ধু—শঙ্কর সিং এবং নিখিল দে-কে সঙ্গে নিয়ে মজদুর কিষাণ শক্তি সংগঠন (MKSS) প্রতিষ্ঠা করলাম। MKSS হল দেবডুংরিতে একটি মাটির কুঁড়েঘরে অবস্থিত সংগ্রাম-ভিত্তিক এক সংগঠন। আমরা কোনও সংস্থার থেকেই টাকা নেই না। এখানেই, অন্যান্য অনেক সংগ্রামের মতোই আর.টি.আই.-এর দাবি তৈরি করা হয়েছিল। তারপরে আমরা এক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছি। এই মুহুর্তে, আমরা একটি জবাবদিহিতা আইনের জন্য সংগ্রাম করছি । সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করার আহ্বান জানাতে রাজস্থানের ৩৩টি জেলায় যাত্রা করছি। এই ধরণের বিভিন্ন কাজ ও সংগ্রামের আমি এখনও শরিক।
প্রভাবশালী আন্দোলন গড়ে তোলার নিদর্শন দেশের মানুষকে দেখিয়েছেন আপনি। কিন্তু, প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল না থাকলে কীভাবে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা বা টিকিয়ে রাখা যাবে?
ফান্ডিং সাধারণতঃ যে কোনও আন্দোলনকে সীমায়িত করে। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন যে, নিজের লোকেদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় যেন এমন সমালোচনার সম্মুখীন হতে না হয় যে সেই লড়াই কোনও এক বিশেষ স্বার্থের অর্থপুষ্ট। তহবিল আসলেও, তা এমন লোকদের কাছ থেকে আসতে হবে যাদের হয়ে লড়াইটা লড়া হচ্ছে, অথবা যাঁরা তাদের সমর্থন করছেন। এইসব প্রচারাভিযানকে নিতান্তই কোনো কর্মসূচী ভাবলে চলবে না।
এই ধরণের অংশগ্রহণমূলক আন্দোলন নানান চলরাশি দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন ধরুন, সরকার মানুষকে কারাবাস দিতে পারেবা মাফিয়া তাদেরকে হত্যা করতে পারে। আবার, অনেক সামাজিক এবং সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো পার হতে হয়। কখন যে কী হবে, তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। ক্যাম্পেইনের ফলাফল কী হবে, তাও আগে থেকে বলা যায় না।
জনমুখী কাজ তিন ধরণের হয়: সেবা, নির্মাণ এবং সংগ্রাম। সেবা, যেমন—যারা অনাহারে আছে বা যারা অসুস্থ তাদের দেখাশোনা ও তাদের খাদ্য সরবরাহ করা। নির্মাণ, অর্থাৎ, স্কুল চালানো বা মহিলাদের দক্ষতা প্রোগ্রাম। এমকেএসএস-এর কাজ সংঘর্ষ বা সংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত। তা প্রায় সবসময়ই বিশদ অর্থে রাজনৈতিক কাজ। যেমন ধরুন, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের কাঠামোর আওতায় সাংবিধানিক অধিকার বুঝে পেতে চাওয়া।
একটি সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য উপরের তিনটি জিনিসেরই প্রয়োজন পড়ে। এমকেএসএস এবং ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলনের মতো সংগঠনগুলির দ্বারা করা অধিকার-ভিত্তিক কাজগুলির জন্য খুব বড় বাজেটের প্রয়োজন হয় না। এখন যাকে ক্রাউড-ফান্ডিং বলে, তা দিয়েই এসব কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়।
আমরা বিশ্বাস করি যে, সমতার লড়াইয়ের সমস্ত সংগ্রামের মূল কোনও না কোনও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মধ্যে থাকে। এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লড়াইয়ের অর্থে নয়, বরং সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের অর্থে রাজনৈতিক। ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকার (ফান্ডামেন্টাল রাইটস) এবং ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপলস অফ স্টেট পলিসি-র অধ্যায়গুলি আমাদেরকে এই লড়াইয়ে ক্ষমতা ও দায়িত্ব—দুই-ই প্রদান করেছে। যুদ্ধ চলাকালীন আমরা বিচার বিভাগ, আইনসভা, বা নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু সর্বদাই দাবি করি যেন তারা সংবিধান মেনে জনগণের স্বার্থে কাজ করে।
MKSS-এর মেম্বার হিসেবে আমরা ন্যূনতম কৃষি মজুরির সমান অর্থ সাম্মানিক ভাতা পাই। আমরা কয়েকজনের একটি ছোট দল—গোনাগুন্তি ২০জন হবে। এবং আমরা ৩১বছরেরও বেশি সময় ধরে এইভাবে চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা যাদের প্রতিনিধিত্ব করি তাদের মতোই জীবনযাপন করি, যাতে আমরা তাদের কীসে কষ্ট হয়, তা অনুভব করতে পারি। মানুষের কাছে আমরা আর্থিক, এবং অন্যান্য যেভাবে সম্ভব, সাহায্য প্রার্থনা করি। আমরা যাদের প্রতিনিধিত্ব করি, কেবল তাদের কাছ থেকেই অর্থ চাওয়ায় বিশ্বাসী। প্রথমত, কারণ এই চাওয়ার কাজটিতে মাথা নত করতে হয়—মানুষ ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব নেই, এবং তাদের অবদান তাদের মর্যাদার দ্যোতক। তা থেকেই তৈরি হয় সমস্যাটির উপর তাদের মালিকানাও। দ্বিতীয়ত, আমরা তাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকি, কারণ তারাই আমাদের কাজের মূল্যায়ন করেন। সুতরাং, আমরা জানি যে, ঠিক করে কাজ না করলে তাদের সমর্থন পাব না।
জনগণের অংশগ্রহণের চেয়ে তাদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থকরী সহায়তার গুরুত্ব সবসময়ই কম। ১৯৯৬ সালে বেওয়ারে আর.টি.আই -এর জন্য সংগ্রামের সুদীর্ঘ ৪০দিনের ধর্না এক যুগান্তকারী অংশগ্রহণমূলক আন্দোলনের উদাহরণ।1 আমরা সমর্থন চেয়ে ৪০০টি গ্রামের ভিতর দিয়ে মিছিল করেছি। প্রতিটি পরিবার পাঁচ কেজি শস্য এবং আমাদের ধর্নায় যোগ দিয়ে চার থেকে ছয় দিন ব্যাপী তাদের মূল্যবান সময় দান করেছেন । বেওয়ার শহরের নিত্যজীবনের একটি অন্যতম মূহুর্ত ছিল সেই ধর্না। সকলে ধর্নার জায়গায় জমায়েত হয়ে তাকে শক্তিশালী করেছিলেন। আমরা সেখানেই খেতাম, সেখানেই থাকতাম এবং নানান অনুষ্ঠান করতাম— যেমন, কবিতা পাঠ, বাবাসাহেব আম্বেদকরের জন্মদিন উদযাপন, শ্রমিক দিবস এবং আরও অনেক কিছু।
আর.টি.আই.-এর লড়াই শুরু হয়েছিল দুর্নীতি এবং ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী-শ্রেণীর এক দাবি হিসাবে। পরবর্তীকালে সেটির সাংবিধানিক মূল্য-, ও গণতান্ত্রিকভাবে কার্যনির্বাহ করার জন্য তার প্রয়োজনীয়তা-বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। এস আর শঙ্করন, আমার এক বন্ধুস্থানীয় আইএএস অফিসার, বলেছিলেন, ” আর.টি.আই. এক যুগান্তকারী আইন, কারণ এর মাধ্যমে আপনি অন্যান্য নানান অধিকার- মানবাধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক অধিকার ইত্যাদি পেতে পারেন।”
এখন দেশের মানুষ বুঝেছেন যে, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারীতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্বচ্ছতা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু বেওয়ারের সেই ধর্নাকে স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্রমিক সংগঠনগুলো আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে সমর্থন না করলে এসব কিছুই সম্ভব হত না। সম্মিলিত কণ্ঠস্বরের এমনই শক্তি। বহু মানুষ একত্র হয়ে কোনও এক ইস্যুর মালিকানা গ্রহণ করেন। তারপর, সেটি তাদের নিজস্ব লড়াই হয়ে ওঠে। এইভাবে চলতে পারলে মানুষ সংগ্রামের শেষ দিন পর্যন্ত আপনার সঙ্গে থাকবে।
বিভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করা অংশীদারেরা কীভাবে আপনার মিশনের সঙ্গে সুসমঞ্জস হতে পারেন?
কিছু নন-নেগোশিয়েবল জিনিস আছে। প্রথমত, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বজায় রাখা বহির্জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে হবে। আমি আমার জন্ম এবং শিক্ষার গুণে একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণী থেকে এসেছি। অথচ, আমি খুব সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্যে কাজ করি। এই বিশেষাধিকারের অবস্থানে থাকলে, কথাবার্তার কেন্দ্রস্থলে নীতিবোধ ও সততার স্বচ্ছ প্রতিফলন থাকতে হবে। যেমন, বেওয়ারে ধর্নায় রোজকার অনুদানের হিসাব পরিষ্কার করে লেখা থাকত ধর্নার জায়গায় একটি বোর্ডে, যাতে তা সকলে দেখতে পান।
দ্বিতীয়ত, সাম্যতার কথা শুধু মুখে বললেই হবে না, মন থেকে সমান হতে হবে। আমাদের জানতে হবে যে সবাই সমান– প্রত্যেকেরই চিন্তা করার, কথা বলার, বা কিছু হয়ে ওঠার অধিকার রয়েছে। সমস্যা তখন হয়, যখন কেউ এসব মৌলিক নীতিতে বিশ্বাস করেন না। আমি যদি বর্ণে বিশ্বাসী একজন ব্যক্তির সাথে জাতপাতের অযৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনায় বসি, তাহলে তাদের সঙ্গে কথোপকথন করতে পারার ক্ষমতা আমার থাকতে হবে। কিন্তু যতক্ষণ না তা হচ্ছে, ততক্ষণ কিন্তু আমাদের সত্যিকারের যোগাযোগ স্থাপন, মিত্রতা, অংশগ্রহণ, বা মানসিক বৃদ্ধি- কোনওটাই হয় না।
দলিত এবং দরিদ্র মানুষ আমাকে শিখিয়েছে যে, সাম্যের এক অন্যতম অভিব্যক্তি হল সংগ্রাম, এবং সমস্যা মোকাবিলা করার সাহস।
সমাজের সব সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর যাতে ভারতের বর্তমান সরকার শুনতে পান, তার জন্য সুশীল সমাজ সংগঠনগুলির কী করণীয়? এই মর্মে তারা ভারতের সরকারের সঙ্গে আরও সক্রিয় যোগাযোগ স্থাপন করবে কী উপায়ে?
আমরা ক্রমেই আমাদের প্রতিবাদ করার অধিকার, ভিন্নমত পোষণ করার অধিকার, এবং পাবলিক স্পেসে প্রবেশের অধিকার হারাচ্ছি। তবে, সেই গণতন্ত্র ভিত্তিহীন, যা সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতি বধির এবং জনগণকে তার নিজের জায়গা থেকে হটানোর চেষ্টা করে। গণতন্ত্রে বাস করতে হলে ভিন্নমত পোষণের এবং তা শোনার অধিকার আমাদের সকলের থাকতে হবে। ভারতের গণতন্ত্রের সমস্যা হল লক্ষ লক্ষ ভোটারের উপস্থিতি সত্ত্বেও, শীর্ষস্থানে সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের সংখ্যা অতি সংকুচিত। সুতরাং তাঁরা নীচের মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পান না। গুটি কয়েক মানুষ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করার মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। উপরন্তু, সেই সিদ্ধান্ত , সংসদে, এমনকী মন্ত্রিসভাতেও নেওয়া হয় না। MKSS বিশ্বাস করে যে পথই আমাদের সংসদ এবং পলিসি রুম। তাই আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করি এবং সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করি। সেখানে নিত্য আমাদের এমন লোকের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়, যারা আমাদের আন্দোলনের অংশীদার নন। সুশীল সমাজের আন্দোলনের জন্য এইরকম উদ্দীপক পরিস্থতির অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা যন্তর-মন্তরে আন্দোলনকারীদের ঢোকা এবং থাকার অধিকার পুনরুদ্ধার করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে একটি পিআইএল দায়ের করি। সেই মামলা জিতে, সকল প্রতিবাদকারীর পাবলিক স্পেস ব্যবহারের অধিকার পুনরুদ্ধারে ২০১৮ সালের জুলাইতে সফল হয়েছি।
আমার প্রজন্মের সৌভাগ্য যে, আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার কখনও খর্ব হয়নি। আমরা নিজেদের পছন্দের কথা স্বচ্ছন্দে বলতে পারতাম। কিন্তু, মনে হচ্ছে, আজ এমন এক শাসনকাল উপস্থিত, যা গণতন্ত্রের মূল উপাদান – স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং বাকস্বাধীনতার পক্ষপাতী না।
অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর.টি.আই আন্দোলনে আমরা সবাই একত্র হয়েছিলাম; যেমন,গণমাধ্যম, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী এবং অন্যান্যরা। জঁ ড্রেজ, জয়তি ঘোষ, প্রভাত পট্টনায়েক প্রমুখ অর্থনীতিবিদ ছাড়া MGNREGA সম্ভব হতো না। তারাও আমাদের সঙ্গে সরকারের ‘টাকা নেই’-রব আর্থিক যুক্তি ব্যবহার করে খণ্ডন করেছিলেন। আর.টি.আই আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান পি.বি. সাওয়ান্ত।
সেরকমই কোনও কর্মকাণ্ড সফল করতে চাইলে বহু লোকের সাহায্য লাগে। আপনাকে আপনার সংকল্প সম্পর্কে তাদের জানাতে হবে – যা কেবল জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ঘটে। সুশীল সমাজ ন্যায় ও সাম্যের কণ্ঠস্বরকে প্রশস্ত করে, তাই তা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। তা একটি বড় ছাতাও বটে; এবং শুধু খেটে খাওয়া মানুষের জন্যনা। কার্যতঃ, তা ভারতের সবার জন্যেই, কারণ রাষ্ট্র ও বাজার ব্যতিরেকে সকলেই কিন্তু সুশীল সমাজ। সুতরাং, যা আছে, তা টিকিয়ে রাখতে লড়াই করতে হবে।
ভারতের তরুণদের জন্য আপনার বার্তা কী? আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব যে আপনি এবং আপনার সহযাত্রীরা আমাদের যে উত্তরাধিকার দান করেছেন তার আমরা সদ্ব্যবহার করতে পারি?
মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রতিটি মানুষের মঙ্গলের জন্য। যে ব্যবস্থা সেই অধিকারকে দমন বা দমনের চেষ্টা করে, তা কেবল গণতান্ত্রিক তথা সাংবিধানিক অধিকারকেই শুধু নয়, মানবাধিকারকেও অস্বীকার করে। জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারকেও অস্বীকার করে। তাই, আজকে আমাদের অনেকের জন্যই প্রধান চিন্তা হল ভারতে এবং সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্র, এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা বজায় রাখা, যার কারণে এত তরুণ-তরুণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
গত সাত বছরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে অধিকারটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে তা হল সমান বাক্-স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের অধিকার। এটি আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের গ্যারান্টি। আমরা যা হারিয়েছি তা যেমন ফিরে পেতে হবে ভবিষ্যতের জন্য, তেমনই, যা আছে, তা বজায় রাখতে হবে। আপনি সংগ্রাম, সেবা বা নির্মাণের সাথে জড়িত কিনা তা বিবেচ্য নয়। এও বিবেচ্য নয় যে আপনার সংগঠন ছোট না বড়, অথবা আপনি নারী না পুরুষ। আপনি কোথায় বসবাস করেন, তাও বিবেচ্য নয়। বাক্-স্বাধীনতা ও নিজ-মত প্রকাশের অধিকার সকলের জন্য সমানভাবে মৌলিক।
আজকের এই ভারতে, তরুণদের সামনে বড় সংগ্রাম রয়েছে সেসব পুনরুদ্ধারের। আর.টি.আই. আইন এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে জরুরি, কারণ তা তার ৮ মিলিয়ন ব্যবহারকারীকে আশ্বাস দিয়েছে, যে তারাই সার্বভৌম। পাবলিক এথিকস-এর ডিসকোর্স তৈরির লক্ষ্যে পৌঁছনোর সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছে এই আইনের প্রচারাভিযান। MGNREGA ও সোশ্যাল অডিট সর্বত্র স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার আবহাওয়া বিস্তার করেছে। এই দুই বড় প্রচারাভিযান, যার আমি অংশ, মানুষের মধ্যে কেবল পার্টিসিপেশন-ই নয়, এথিকাল পলিসিকে বাস্তবায়নযোগ্য পলিসিতে পরিবর্তিত করেছে। এ এক মস্ত বড় ব্যাপার। কারণ, এথিকাল পলিসিকে বাস্তবায়িত করে মানুষের ধরা-ছোঁওয়ার মধ্যে আনতে না পারলে তা কেবলই কাগজে-কলমে আটকে থাকে।
তরুণদের বুঝতে হবে যে, ‘নিজের কাজ’ এবং ‘পরের কাজ’ বলে কিছু নেই। যা আছে, তা হল, ‘কাজ’। এ আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে অনেক বড়। আমরা বিভিন্ন ইস্যু-র প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যম মাত্র। কাজের স্বীকৃতি পাওয়া সবসময়ই ভালো। কিন্তু ভাবতে হবে, তা কী মূল্যে হাসিল করা হচ্ছে? আসলে যে সবার ভালোর মধ্যেই একের ভালো নিহিত রয়েছে, তা বোঝা দরকার।
আপনি উপসংহারে কিছু বলতে চান?
আমাদের দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত এবং অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে। সুশীল সমাজের মধ্যে থেকে যারা সেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেন, এবং প্রান্তিক জনের কণ্ঠস্বরকে বলিষ্ঠ করেন, তারাও আজ আক্রমণের শিকার। আলোচনা এবং বিতর্কের পরিবর্তে মানুষে মানুষে হিংসা মতবিরোধ-নিষ্পত্তির উপায় হয়ে উঠেছে। হিংসার ঘটনায় অভিযুক্তদের প্রতি রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্য সমর্থন সার্বিক ক্ষতি ডেকে আনছে।
আমাদের অহিংসার সংস্কৃতি লালন করতে হবে। অহিংসার জনক হল সহনশীলতা, সাহস এবং জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। তা ভারতের এক মহান ঐতিহ্য, যা ক্রমেই সবাই বিস্মৃত হচ্ছেন। মত-বিনিময় এবং জন-সংলাপের জন্য আমাদের ফোরাম তৈরি করতে হবে, যাতে সাংবিধানিক গণতন্ত্র পরিপুষ্ট হতে পারে।
আমি এক মুক্তমনা সমাজ কামনা করি যেখানে তরুণ প্রজন্ম সাংবিধানিক নৈতিকতার চৌহদ্দির মধ্যে নির্ভয়ে গঠনমূলক কাজ করতে পারবেন।
পরিশেষে বলি, আমার জীবনের এই সফল পরিণতির জন্য হাজার হাজার লোকের অবদান রয়েছে। তাদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। সেই সব মানুষের আশীর্বাদ আমাকে আশ্বস্ত করেছে যে, মানবতাবাদ মঙ্গলের দ্যোতক। সমতায় বিশ্বাসী, ন্যায়ের পথে চলা মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্ব সুবিধাপ্রাপ্ত এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে একটি সেতুস্থাপন তৈরি করা। আর যে ক’বছর আমি বাঁচব, তাতে যেন কখনওই ক্ষমতাবানের সামনে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলতে পিছপা না হই।
এই প্রবন্ধটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করা হয়েছে একটি অনুবাদ টুলের মাধ্যমে; এটি এডিট করেছেন গীতিষা দাশগুপ্ত ও রিভিউ করেছেন কৃষ্টি কর।
—
পাদটীকা:
1. MKSS কালেকটিভের সাথে অরুণা রায়। ‘হামারা পয়সা হামারা হিসাব: বেওয়ার অ্যান্ড জয়পুর ধরনাস, 1996’, দ্য আরটিআই স্টোরি: পাওয়ার টু দ্য পিপল । নতুন দিল্লি: রোলি বুকস, 2018।
—
আরও জানুন
- আরটিআই আইন কীভাবে এসেছে সে সম্পর্কে আরও জানতে শঙ্কর সিংয়ের এই TEDx টক দেখুন।
- বইটির থেকে একটি অংশ পড়ুন : জনগণের ক্ষমতা।
- কার্যকর জোট গঠনের বিষয়ে অরুণ মাইরার এই দৃষ্টিকোণটি সম্পর্কে পড়ুন।